গ্রীষ্মকাল যেন শেষ হয় না। গত কয়েক মাস ধরে বৃষ্টি ও গরমে সবসুদ্ধ অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে জীবন যাপন করা হচ্ছে। শীতকাল খুব তাড়াতাড়ি চলে যায়। গোসল করে বাগানের দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় সব গাছ শুকিয়ে গেছে। বুকটা কেমন ছ্যাঁত করে ওঠে।
বাবার হাতে লাগানো গাছগুলি। আগস্ট,সেপ্টেম্বরে।তারপর বাবার হঠাৎ করেই মৃত্যু। করোনা
ভাইরাস এ আক্রান্ত হয়েছিলেন। হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়, কয়েক দিন এর মধ্যে সব কিছু শেষ হয়ে যায়।
বাবার লাশের পাশে কেউ ছিল না, মা শুধু একা বসে কাঁদছিল। রাত তখন ১১টা, চারিদিকে আঁধার নিস্তব্ধ শহর
লোকারণ্য এই জীবনে এমন কিছু কষ্ট থাকে যা আগে থেকে ভাবা যায় না।
বাবা যে কোম্পানি তে চাকরি করতেন
সেখান থেকে প্রফিডেন্ট ফান্ডের কিছু
টাকা সহ যে টাকা পেয়ে ছিলাম তা দিয়ে আপুর বিয়ে বাকী টা পোস্টাফিসে ফিক্সড।
আপুরা থাকে শ্যামলী আদাবর আসিফ ভাই প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকুরী করে। বহুদিন আপুর কাছে যেতে বলেছে আমি যেতে পারি নাই। এখন মাঝে মাঝে খুব যেতে ইচ্ছে করে,
মাকে ফেলে কি যাওয়া যায়!
চাকরির শুরু তে বাবা বাড়িটা মিরপুর
১২ নম্বরে করেছিলেন। বাবা নিজের হাতে বাগান করেছিল। গ্ৰিল বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত।বাগানে ফুল ফোটা দেখত। দূরের পাতা ঝরা আর জোৎসনার লুকোচুরি। মাঝে মাঝে আমিও বাবার পাশে গিয়ে বসতাম। বাবা বলতো ঘাড়টা একটু টিপে দে মা। আমি দিতাম। বাবা বলতো —তোর জন্য খুব চিন্তা হয় রে!
কী চিন্তা আমি সেটা বুঝি। বাবা মেয়ের জন্য ঘর জামাই খুঁজতে চেয়েছিলেন। সে রকম পাত্র পাওয়া যায়নি। তবে ভালো ছেলে পাওয়া গিয়েছিলো। তবে অনেক ডিমান্ড ছিল
মা বাবা কে বলতেন ওর জন্য চিন্তা করো না ও আমার কাছেই থাকবে।
বাবার মৃত্যুর পর আমাদের জীবন যাপনের ধারাই পাল্টে গেল। মাও অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। আমার সাথে কথা বলতে গিয়ে মাঝে মধ্যে রেগে উঠেন। আবার একা নিঃশব্দে কাঁদেন। আমি কিছু বুঝতে পারি না।
চুল থেকে গামছাটা খুলে তারে মেলে দিয়ে চুল আচড়াতে লাগলাম। সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা। আসমা আর শুভ্রা আসবে পড়তে। ওরা ছাড়া আরো চার জন পড়ে আমার কাছে। এম এ টা আর পড়া হলোনা আমার। অনার্স কমপ্লিট করে শেষ। সংসারে অভাব, বাবার সীমিত আয়ে।পড়া শেষ করতে পারি নাই। ভেবেছিলাম লাইব্রেরিয়ান
কোর্স টা করবো। খরচের ব্যাপারে মাকে গম্ভীর হতে দেখে আর পা বাড়াইনি। সবার তো সব কিছু হয় না।
প্রেমট্রেম করার সাহস কখনো হয়নি।
যা কোনজারভেটিব বাড়ি! আপু একবার শামীম ভাইকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল বলে বাবা আপুকে বেদম প্রহার করেছিল।
এই মাত্র ওরা এলো টেবিলে বসে
আমার ছাত্রীদের নোটস লিখতে দিলাম।তারপর মাকে কুটনা কুটে দিতে বসলাম। মাকে খুব গম্ভীর মনে হচ্ছিল ।কেন জানি না। মাঝে মাঝে মাকে খুব খিটখিটে মনে হয়। অকারণে আমাকে বকাঝকা করে।সেদিন যেমন চাল ধুয়ে জল ফেলিনি বলে রাগ দেখিয়ে চারটা ফেলে দিল।
আসলে ইদানীং মায়ের মতের সঙ্গে আমার মেলেনা। কথার মানে বোঝে উলটো। সময় পাল্টেছে, মানুষের চিন্তা ভাবনার কত পরিবর্তন ঘটেছে। মা সে সবের কোন তোয়াক্কা করে না। আজ কেন রেগে আছেন বুঝতে পারছি না।
কিছু বলতেও সাহস হয় না। একটির পর একটা দিন যায়।কত নিঃসঙ্গ আমরা। আত্মীয় স্বজনের আসা যাওয়া
এখন অনেক কমে গিয়েছে। সন্ধ্যায় আমাদের তেমন কোন কাজ থাকে না।
দুপুরেই রান্না সেরে রাখি। রাতে শুধু কটা রুটি করে নেই, ফ্রিজ থেকে তরকারি গরম করে খাই।
মা টিভি দেখে প্রায় প্রতিটি সিরিয়াল দেখে। মাঝে মাঝে আমি দেখি। নাহলে
ছাত্রী দের জন্য নোটস তৈরি করি, গল্প
প্রবন্ধ রচনা পড়ার চেষ্টা করি। সন্ধার পর কবরী ভাবি আসেন, আমাদের প্রতিবেশি। ওকে আমার খুব ভাল লাগে
পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বয়স হবে। খুব সুন্দর দেখতে। কেমন জানি পবিত্র পবিত্র মনে হয়। শিক্ষিত এবং অভিজাত পরিবারের মেয়ে। আস্তে আস্তে কথা বলে।কোন ব্যাপারে তাড়াহুড়া নেই। নেই কোনো পরচর্চা। ভীষন আন্তরিক মনে হয় ,মনের সব কথা বলা যায়। বিশ্বাস করা যায়। ভাবীকে দেখলে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। বুকের ভিতর অনেক বাতাস অনুভব করি।
অনেকক্ষণ গল্প করলাম। মনটা হালকা লাগছে।
মা গেছিল ছোট চাচার বাসায়। একসময় ছোট খাটো ব্যাপারে কিছু মনে করতাম না। এখন ছোট ছোট বিষয় গুলো ভীষণ আঘাত করে। নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করলাম
রাতে রুটি সেকছিলাম।বেলতে বেলতে মা বলল,ছোট চাচা নাকি আমার জন্য পাত্র খুঁজে পেয়েছেন। ছেলেটি ব্যাঙ্কে চাকরি করে। কাছেই কোথাও বাড়ি।
মনে একটু দোলা লাগে। মা একটু জিরিয়ে নেয়। শরীর কত ভেঙ্গে গেছে।
বেশী কাজ করতে পারে না।তিনটে রুটি বেলে হাফিয়ে যায়। এখনো মা কি সুন্দর। লোকে বলে আমি নাকি মায়ের মতো দেখতে। মা এখন আর রঙিন শাড়ী পরে না। —বলি পরতেই তো পারো।
—তোমার কী এমন বয়স!
—মোটে বায়ান্ন
—ছেড়ে দাও। বেলে নিব।
—মা বলে ওদের অনেক চাহিদা ।
বিয়ের ইচ্ছা আগে ছিল না। এখন জাগে।সন্ধ্যা হলেই সারা বাড়ি ঝিমিয়ে
পড়ে। চারিদিকে শূন্যতা। নিস্তব্ধতায় বুকের ভিতর কেমন হু হু করে। ভাবি আমি চলে গেলে মা থাকবে কেমন করে। কাকে নিয়ে বাঁচবে। বড় কষ্ট হয়
এই সময় আপু থাকলে খুব ভাল হতো
আমায় আদর করত,জড়িয়ে ধরতাম।
মায়ের উপর রাগ অভিমান ঝগড়া কিছুই করতে পারি না। শুধু ভাবী মা বাবা কি স্বার্থ পর!তবু মা কে ভালবাসি।
একসন্ধ্যায় মেজ খালা এলেন। খালুর ডাক্তার বন্ধুরা মিলে একটা নার্সিং হোম খুলেছেন।আমাকে রিসেপশনিস্টের একটা কাজ দেওয়ার কথা বার্তা চলছে।সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যে ছটা পর্যন্ত। লাফিয়ে উঠি।
মুক্তি খুঁজছিলাম।
বাড়িতে আমার দম আটকে যাচ্ছিল। একাকিত্ব থেকে বেরোনোর পথ খুঁজছিলাম।নিজেকে সবার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। বললাম, খালা
আমি করবো, ঠিক পারবো। মা শুনে চুপচাপ হয়ে গেল।বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম আমি সারাদিন একা থাকতে পারবো না। মেজ খালা বলছিল আগামী বছরের। মধ্যে আমার বিয়ে দিবেন। বাবার বাৎসরিক কাজের পর সব শেষ করবে।
মনটা যেন কেমন করে ওঠে, কিসের দ্বন্দ্ব কিসের লড়াই কোথায় মানুষের আত্মতুষ্টি বুঝি না। গুলিয়ে ফেলি জীবনের প্রয়োজনীয়তা।হাড়িয়ে যায় যুক্তিবোধ। অন্ধকারে ভেসে ওঠে মুখোশ _পরা মানুষগুলি।কাউকে চিনতে পারছি না। ভয় করে। দৌড়ে ছাদ থেকে নেমে আসি নীচে।
মা বলে —কিরে হাঁফাচ্ছিস কেন? কিছু না। দৌড়ে বিছানায় শুয়ে মুখ চেপে ধরি।বুজতে পারছি মা এসে দাঁড়িয়ে আছে সামনে।
আজ কেউ পড়তে আসবে না। তাড়াতাড়ি গোসল করে নিলাম। চুল আঁচড়ে মুখে একটু সানস্ক্রিন লোশন ঘষে নিলাম। সাজতে আমার ভালো লাগে না। মাকে হরলিকস আর বিস্কুট দিয়ে বেড়িয়ে পরলাম। অনেক কাজ। মায়ের ঔষধ কিনবো, বাজার করবো, পোষ্ট অফিস থেকে টাকা তুলবো।
রোদ্দুরের খুব তাপ। জোরেই বেশ হাঁটছিলাম,ছাতা নিতে ভুলে গেছি। আসার সময় রিকশা করে আসব। রাস্তায় অদিতির মায়ের সাথে দেখা। ও আমার সাথে স্কুলে পড়তো। খুব সুন্দরী মেয়ে, স্কুল থেকে ফেরার পথে অনেক ছেলেরা ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত
ওকে দেখবার জন্য। অদিতির আগামী মাসে বিয়ে।ছেলেটি রেলে চাকরী করে।
ধানমন্ডিতে বাড়ি। অনেক কিছু বলল
মহিলা।আকারে ইঙ্গিতে জানতে চাইল
আমার বিয়ের কোন খবর আছে নাকি
বললেন — তুমি খুব বোকা
মা বাবার সেবা করতে গিয়ে সময় নষ্ট করে ফেলছো।কিন্ত মায়ের সেবা করা
কৃতিত্বপূর্ণ একটা কাজ সেটা তাকে বোঝাতে পারলাম না। বাড়ী ফিরলাম ।
রান্না চাপাতে হবে।
জিঞ্জেস করলাম —কী রাধঁব মা?
—যা খুশি তোর রাঁধ।পাশ ফিরতে ফিরতে মা বলে—আমার মরণ হলে বাঁচি!
কেউ কি কিছু বলছে।কী জানি! মাকে ঠিক বুঝতে পারি না। এত সেবা যত্ন করছি তবুও মা কেন জানি রেগে যাচ্ছে, বুঝলাম না। কিছু বুঝতে পারছি না কিছু জিঞ্জেস করতে ভয় পাচ্ছি। বুকটা কেমন হু হু করে। হঠাৎ করে মা বলে উঠে —তোর আপুকে একটা চিঠি পৌঁছে দে ওখানে গিয়ে কয়েক দিন থেকে আসি। মনে হল মা
বোধ হয় পাগল হয়ে যাচ্ছে। যে মানুষ বাড়ি থেকে কোথাও যেতে চায় না সে
হঠাৎ এ কথা কেন বলছে?
বললাম — দেব।
দিন দিন আমরা যা কেমন হয়েছে যাচ্ছি। দুজন মাত্র মানুষ।অথচ আমাদের মধ্যে কত যোজন দুরত্ব। কেউ কাউকে ঠিক মতো বুঝতে পারছি না। আমাদের মাঝখানে যে কীসের আড়াল বুঝতে পারি না।মায়ের
আচরণের কোন প্রতিবাদ করি না। কত কিছু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি—মা হয়তো বোঝেনা।মাও হয়তো চেষ্টা করে —আমি বুঝি না । পরক্ষণেই মনে হয় বাবার মৃত্যুটা মা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। মা কি বোঝে না মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকে না। নাকি আমার দায়িত্ব নিতে পারছে না। আমার ভবিষ্যত কী! কই আমি তো স্বার্থপর হতে পারলাম না। মাঝে মাঝে মাকে অহংকারী পাষান হৃদয়ের মনে হয়।
তখনই মা পিঠে হাত রাখে। আদর করে। কাছে টেনে নেয়। আমি তখন মায়ের দেহের সঙ্গে, মনের সঙ্গে, অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে যাই। চোখের পাপড়ি ভিজে ওঠে।
আজকাল কারো বাড়ি যেতে ভাল লাগে না। মা কিসের ভয়ে ভোগে জানি না।বিকেলে মা আমার চুল বেঁধে দেয়।
তার নরম হাতের স্পর্শ আমার শিরায় শিরায় ছুটে বেড়ায়।কী এক মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। মা কে ছেড়ে কখনো
চলে যা ভাবতেই পারি না।
আবার কিছুদিন এমনি চলে কিছুটা সময় যেতেই শুরু হয় মনকষাকষির পালা। একে অপরের কাছে কত অপরিচিতা হয়ে উঠি। এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি দু’জন দুজনকে। কাজের বুয়া কামাই করলে মা চেঁচাতে শুরু করে। রাগ দেখিয়ে বিভিন্ন ধরনের দোষ খুঁজতে থাকে।কাল রাতে কেন বাসন মাজিনি। বারান্দায় পাতা ঝরে আছে ঠিক মতো মোছেনি। আমি কেন দেখলাম না। রেগেমেগে নিজেই মোছা শুরু করে দিল। আমি কোন কথা বললাম না। চুপচাপ গোসল করতে গেলাম, আমার ছাত্রীদের আসার সময় হয়ে এলো। মায়ের সাথে সকাল থেকে
একটি কথা বলিনি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে কেন শুধু শুধু আমার উপরে রাগ করবে? একদিন সত্যি সত্যি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। যে দিকে দুচোখ যায়।
আর ফিরবো না। কিসের জন্য ফিরবো? কার জন্য ফিরব? দায়বদ্ধতা শুধু আমার বড় বোনের কোন দায়িত্ব
নেই! আপু স্বার্থপর এর মতো নিজের সংসার ছাড়া কিছুই বোঝে না, একবার জানতে চাইল না বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের সংসার কিভাবে চলছে। ভীষন আত্মকেন্দ্রিক।মা’রচোখ
সেটা দেখে না। প্রথম দিকে একহাজার টাকা পাঠাত, এখন আর আগের মতো খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন মনে করে না।
টাকাও পাঠায় না। চারিদিকে আঁধার শূণ্য মনে হয়। দিনের বেলা কোনরকমে কাটে।মানুষের কোলাহল, রাস্তায় সাইকেল স্কুটার, রিকশার শব্দ
পাখির কলরব সূর্যের আলোয় কোথা দিয়ে যে সময় গড়িয়ে যায় বুঝতে পারি না। আকাশের তাররাগুলো যখন ফুটে উঠলেই আবার নিঃসঙ্গতা একাকিত্ব শব্দহীনতা চারপাশ থেকে আমাদের
আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। এভাবেই আমাদের চোখের ভাষাও বদলে গেছে
পরিচিত মানুষজনকেও অন্য ভাবে দেখি। বুঝতে চেষ্টা করি তাদের উদ্দেশ্য
বোঝাতে চেষ্টা করি আমাদের অস্তিত্ব।
কৌলীন্য,নিয়মানুবর্তিতা,নাক উঁচু ভাব সীমাবদ্ধতায় মাঝে মাঝে
হাঁফিয়ে উঠি। মুক্তির পথ খুঁজে বেড়াই
মনে মনে ভাবি কোথায় চলে যেতে পারতাম! সত্যি একদিন কোথাও আমি চলেই যাব। মন বলে।কিন্তু কোথায় যাব? পায়ে যে শিকল বাধা।
সন্ধ্যা তারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দু চোখের পাতা যে কখন ভিজে যায় বুঝতে পারিনা। ও পাড়ার মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজান
_আল্লাহ হো আকবর…..
কদিন ধরে জ্বরে খুব ভুগলাম।আজ দুপুরে অল্প একটু ভাত খেলাম।মায়ের
খুব ধকল গেল। মাথায় জলপট্রি দেওয়া টাইমে ঔষধ দেওয়া,পথ্য,রাতে টেম্পারেচার দেখা। সব করেছে মা।এই
মাকে আমি কত বছর পর পেলাম মনে
করতে পারছি না। যে মায়ের দাপটে বাবাও চুপ হয়ে যেতো।সেই মা যে এত
মমতাময়ী ভাবতেই অবাক লাগে। নতুন করে আবিষ্কার করি মাকে। দুপুরে খাওয়ার পর শুয়ে শুয়ে পাশের বাড়ির থেকে খবরের কাগজ এনে ছিলাম। এখন আর আমরা কাগজ রাখি না।মা এসে পাশে শুল।
আমি কাগজ রেখে মাকে জড়িয়ে ধরলাম।
—মা..
—কী বল?
—কদিন তোমার খুব কষ্ট হলো, না?
—আমার গাল টা টিপে দিল মা।
—বলল আর ঢং করিস না তুই! খারাপ কিছু হতে পারতো!
—তুমি খুব চিন্তা করেছিলে, তাই না।
—চিন্তা হবে না! বলিস কী রে? মা অবাক। তোর জন্য কত চিন্তা আমার।
মায়ের মুখের কাছে গিয়ে বললাম,আচছা মা আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে না…
—খুব ফাজিল হয়েছিস তো! মা কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলে।
—আমি খুব আনন্দিত!
আদর খেতে খেতে, হাসতে হাসতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। আমরা জানি কেমন, অথচ আমাদের সব আছে। থাকার জায়গা আছে, মানসন্মান আছে, রুচি শিক্ষা আর বেঁচে থাকার সঙ্গতি। তারপর ও আমাদের সবাই বোকা বোকা ভাবে।
সন্ধ্যায় ছোট খালা এলেন মায়ের উপর রাগ অভিমান করলো কেন আমাকে এখনো বিয়ে দিচ্ছে না।মেয়ের শরীর শুকিয়ে গেছে, লাবন্য নষ্ট হয়ে গেছে
তোর চোখে পড়ে না। মা নাকি চিরকাল ই ভীষণ হিংসুটে। আমার দিকে তাকিয়েও দেখে না। ছোট খালার
এলাকায় থাকে একটি ছেলে, সরকারী
চাকরি করে। কাল ই খালা ছেলেটির মায়ের সাথে কথা বলবে। আমি শুয়ে ছিলাম।দূর্বল লাগছিল অজান্তে ঘুমিয়ে পরি। খালা চলে গেছে।মাথার গোড়ায় বসে মা পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর
ডাকছেন মা ওঠ। দুটো ভাত খেয়ে নাও
—কটা বাজে মা?
—পৌনে দশটা
আমি উঠতে চেষ্টা করি, পারি না। মা ধরে উঠায়। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, কানের ওপর দুতিনটি সাদা চুল চিকচিক করছে। ফরসা ধপধপে তার শরীর। কী সুন্দর গন্ধ পাই
মায়ের কাছ থেকে। স্নেহের দৃষ্টিতে মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার কপালে হাত রেখে বললো —না
জ্বর নেই। কতদিন পর মায়ের মিষ্টি কন্ঠ শুনলাম —খেতে হবে ,চল।
মাকে জরিয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলাম। আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন মা।আমার চোখের পানি বোধ হয় মায়ের পিঠে পড়েছিল।মা বললো —কাঁদছিস কেন বোকা মেয়ে?
—কি হয়েছে তোর?
—তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। কক্ষনো নয়।
—মা বুকে চেঁপে ধরে আমায়। বলে—খুব বোকা তুই। তাইকি হয়!
মায়ের কণ্ঠস্বর ভিজে যায়।
মায়ের চাপে শরীরে মিশে যেতে যেতে
মনে হচ্ছিল ‘আমিই মা আর মা আমার মেয়ে’।